১৬ ডিসেম্বর

১৬ ডিসেম্বর কি দিবস?

১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশে একটি জাতীয় উৎসব ও গৌরবের দিন হিসেবে পালিত হয়। এটি বাংলাদেশের বিজয় দিবস, যে দিনটিতে দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করি এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি। এই দিনটি বাঙালি জাতির জন্য এক যুগান্তকারী মুহূর্ত, যা আমাদের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ও প্রেক্ষাপট

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের পর পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি অংশ হয়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে শুরু করে। ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাঙালিদের প্রতি অবিচার এবং শোষণ দীর্ঘদিন ধরে চলছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসার পরও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। এ সকল ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে ক্ষোভ এবং স্বাধীনতার দাবী আরও দৃঢ় হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ও চূড়ান্ত বিজয়

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক অসম যুদ্ধ। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় অভিযান চালিয়ে নিরীহ বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করে। এ ঘটনায় বাঙালি জাতি সমগ্রভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিল। মুক্তিযোদ্ধারা নানা রকম প্রতিকূলতার মধ্যেও পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সুসংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা, দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যায়। ভারতও বাংলাদেশের পক্ষে সহযোগিতা করে, যা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজি মিত্রবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। তার সঙ্গে ৯৩,০০০ সৈন্য আত্মসমর্পণ করে, যা বাংলাদেশের বিজয়কে নিশ্চিত করে। এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে এক নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে।

১৬ ডিসেম্বরের তাৎপর্য

বিজয় দিবস বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা। এটি শুধুমাত্র একটি সামরিক বিজয় নয়, বরং একটি জাতির আত্মপরিচয় এবং স্বাধীনতার প্রতীক। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বাঙালি জাতি কখনোই অন্যায় এবং অবিচারের সামনে মাথা নত করেনি। এটি একটি সংগ্রামী জাতির আত্মপরিচয়কে প্রতিফলিত করে, যারা স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত ছিল।

বিজয় দিবস উদযাপন

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে উদযাপিত হয়। দেশের সব স্থানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়, স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি উদযাপিত হয়। বিজয় দিবসের প্যারেড, স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনাসভা এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজিত কনসার্টের মাধ্যমে জাতি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে।

১৬ ডিসেম্বরের গুরুত্ব আজকের প্রেক্ষাপটে

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও বিজয় দিবস আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হতে এবং দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে। যদিও বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অনেকদূর এগিয়েছে, তবুও আমাদের এখনো স্বাধীনতার মূল্যবোধ ধরে রাখতে এবং দেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। বিজয় দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের পূর্বপুরুষরা যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, সেই স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর দেশ গড়ে তোলাই আমাদের দায়িত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *